চকোলেটের ইতিকথা History of Chocolate
চকোলেটের ইতিকথা
History of Chocolate
দ্বিতীয়
বিশ্বযুদ্ধের এক বিষণ্ণ সকাল। হিটলার তখন ধ্বংসের নেশায় মগ্ন। ইহুদিদের রক্তে ভিজছে
তাঁর হাত। আমরা জানতে পারছি পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারশ'র একটি নাৎসি কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে
ইহুদি নিধনের বীভৎসতার কথা। জানাচ্ছেন রোমান চলচ্চিত্রকার পোলানস্কি তাঁর 'দ্য পিয়ানিস্ট'
চলচ্চিত্রে।
সেলুলয়েডের
কল্পিত ছবি। কিন্তু তা দেখে আমরা শিহরিত হই। আমরা দেখতে পাই উদবাস্তু এক ইহুদি পরিবার
তাদের শেষ সম্বল এক টুকরো চকোলেট ভাগ করে খাচ্ছে। বাবা তার পরিবারকে পরম মমতা-পরম স্নেহে
আড়াল করে রেখেছে নাৎসি বুলেট-মৃত্যুর মুখ থেকে। সে জানে, এমনকী তার পরিবারও জানে মৃত্যু
আসন্ন। যে-কোনো মুহূর্তেই তাদের জীবন ছিনিয়ে নিতে পারে নাৎসি-থাবা। তবু তারা স্বপ্ন
দেখে বেঁচে থাকার, যুদ্ধ শেষের সাদা পতাকা দেখার। তাই প্রত্যেকেই নির্লিপ্ত চাহনিতে
খুঁজছে যুদ্ধ শেষের দিন আর একসাথে হয়তো জীবনের শেষ খাবার খাচ্ছে, একফালি চকোলেট। পরিবারের কর্তা তার
জমানো শেষ পুঁজি দিয়ে চড়া দামে কিনে আনা অমূল্য সম্পদ পরিবারের ছয় সদস্য ভাগ করে খাচ্ছে।
আশা করছে যুদ্ধ শেষে বেঁচে থাকার। এই আশার সাক্ষী থাকছে একখণ্ড চকোলেট।
শিশুর
মুখের হাসি থেকে বৃদ্ধের খুশি, প্রেমের আহ্লাদ থেকে বিচ্ছেদের যন্ত্রণা, হামাগুড়ি থেকে
হুইল চেয়ার, সবেরই সাক্ষী একটুকরো নরম-নরম চকোলেট। এক কথায় তুমি জীবনজুড়ে এতোটাই আছ,
তাই তোমাকে নিয়ে ভাবিনি কখনও আলাদা করে।
আর
ভাবতে গেলে আমাদেরকে টাইম মেশিনে ভর করে পিছিয়ে
যেতে হবে প্রায় চার হাজার বছর আগে। তখন মানব-ইতিহাসে লেগেছে সভ্যতার হাওয়া। আজ থেকে
চার হাজার বছর আগে মেসো আমেরিকা, বর্তমান মেক্সিকোতে
পথ চলা শুরু চকোলেটের।
ইতিহাসবিদরা
বলেন এখানেই প্রথম কোকো গাছ পাওয়া গিয়েছিল। এখানকার আদিবাসীরাই প্রথম কোকো বিনস থেকে
চকোলেট তৈরি করেছিল। সেই চকোলেট তারা যেমন বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানে ব্যবহার করত, তেমনই
ব্যবহার করত ওষুধ হিসেবে।
তবে
কোনো-কোনো ইতিহাসবিদদের মতে চার হাজার নয়, প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে অ্যাজটেকরাই প্রথম
চকোলেটকে পানীয় হিসেবে খেতে শুরু করে।
চার
না আড়াই হাজার, এই নিয়ে দ্বিমত থাকলেও একটি ব্যাপারে ইতিহাসবিদরা সহমত যে, বহু আলোচিত
মায়া সভ্যতায় চকোলেটের ব্যবহার ছিল। পুরাতত্ত্ববিদরা ছয়শ খ্রিস্টপূর্বে মায়ানদের মধ্যে
চকোলেট ব্যবহারের বহুল প্রমাণ পেয়েছেন।
প্রাচীন
মায়ানদের লিখিত ইতিহাস থেকে জানা যায়, চকোলেটকে তারা শুভ মনে করত। যে-কোনো সরকারি
অনুষ্ঠানে, অভিজাতদের আপ্যায়নে, বিয়ের আচার-অনুষ্ঠানে, এমনকি অন্ত্যেষ্টির অর্ঘ্য নিবেদনে
এবং অবশ্যই উদ্দীপক পানীয় হিসেবে মায়ানদের মধ্যে চকোলেটের বহুল প্রচলন ছিল। এমনকি আরও
দু’শো বছর পর, চারশো খ্রিস্টপূর্বে মায়ানরা কোকো বিনসকে মুদ্রা হিসেবে ব্যবহার করত,
ঠিক আমরা যেমন মুদ্রার বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করতাম কড়ি।
মায়ানরা
চকোলেটের বহুল ব্যবহার করলেও কোকো বিনসকে কীভাবে পান বা আহার উপযোগী করে তুলত তা পরিষ্কার
নয়। বিভিন্ন পাত্র ও পাথরের যন্ত্রাংশ থেকে অনুমান করা হয় কোকো বিনসকে জলে সেদ্ধ করে
শুকিয়ে ভাজা হত, তারপর তা পাথর দিয়ে থেঁতলিয়ে আগুনে-গরম আরও একটি পাথরে রেখে পেস্ট
তৈরি করা হত। সেই পেস্ট ঠান্ডা হয়ে গেলেই তৈরি হত চকোলেটের শক্ত খণ্ড। এরপর সেই খণ্ড
চকোলেট জলে গুলে তৈরি হয়ে যেত ঘন-ফেনাময় পানীয়। পানীয়কে সুস্বাদু করতে যোগ করা হত
লঙ্কা এবং মধু। বর্তমানের চকোলেট সেকের আদি রূপ আর কি !
কালের
নিয়মই ভাঙা এবং গড়া। সেই নিয়ম মেনেই ভেঙে গিয়েছে মায়া সভ্যতা। কালের গহ্বরে হারিয়ে
গিয়েছে মায়ানরা। এসেছে নতুন সভ্যতা, অ্যাজটেক।
অ্যাজটেক
সভ্যতা চকোলেটকে নিয়ে এল আরও কিছুটা উন্নতির দিকে। ১৪২৮-এ প্রতিষ্ঠিত অ্যাজটেক সভ্যতার
অধিবাসীরা বিশ্বাস করত কোকো ফল স্বয়ং ঈশ্বর তার বাগান থেকে অ্যাজটেকদের উপহার দিয়েছেন
তাদের জন্য। ঈশ্বরের উপহার, ফলে তার গুরুত্ব অপরিসীম। মায়ানদের মতো অ্যাজটেকরাও মূলত
পানীয় হিসেবেই চকোলেটকে পান করত, তবে মায়ানদের মতো সর্বজনীন ছিল না অ্যাজটেকদের ব্যবহৃত
চকোলেট। শাসকদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এবং দেবতার নৈবেদ্য হিসেবেই চকোলেটের ব্যবহার
করত অ্যাজটেকরা। ফলে চকোলেট চলে যায় সাধারণ আম-জনতার নাগালের বাইরে। চকোলেট হয়ে যায়
উচ্চবিত্ত, অভিজাত সম্প্রদায়ের বিলাসিতার ভোগ্য পণ্য। ফলে কোকো বিনস হয়ে উঠেছিল সোনা-রূপোর
মতো দুর্মূল্য।
কিন্তু
ইতিহাস তা মানবে কেন ! যা সমাদৃত, আদরণীয় তা তো সর্বজনের। ইতিহাসের ধারাবাহিকতা তো
তাই বলে। সেই ধারাবাহিকতা চলমান রাখতেই একসময় চকোলেটও হয়ে যায় সর্বজনের। আর এর কৃতিত্ব অবশ্যই স্পেনের। অ্যাজটেকদের থেকে চকোলেট
চলে আসে স্পেনে এবং হয়ে ওঠে সর্বজনের। কিন্তু কীভাবে এল এই বিবর্তন, এবার সেদিকে একটু
তাকানো যাক।
ইতিহাসবিদরা
বলে থাকেন, কলম্বাস তার চতুর্থ সমুদ্রযাত্রা (১৫০২, ১৫ অগস্ট)-র শেষে আমেরিকা থেকে
কোকো বিনস নিয়ে আসেন এবং পরিচয় ঘটান ইউরোপিয়ানদের সঙ্গে। যদিও এর ভিন্নমত আছে। কোনো-কোনো
ইতিহাসবিদ দাবি করেন কলম্বাস নয়, স্প্যানিশ বীর হারনান কার্টেজই স্পেনের সঙ্গে কোকো
বিনসের পরিচয় ঘটায়। অ্যাজটেক সম্রাট মন্টেজুমার দরবারে হারনান কার্টেজ চকোলেটের স্বাদ
পেয়েছিলেন এবং দেশে ফেরার সময় সঙ্গে করে নিয়ে আসেন কোকো বিনস। আরও একদল ইতিহাসবিদ
দাবি করেন, কলম্বাস বা হারনান কার্টেজ, দুইজনের কেউই নন, ১৫৪৪-এ স্পেন সম্রাট দ্বিতীয়
গুয়াতেমালান স্বয়ং নিজে মায়া ভিক্ষুকদের কাছ থেকে কোকো বিনস উপহার পেয়েছিলেন এবং নিয়ে এসেছিলেন নিজ দেশে।
এক অনামা স্পেনীয় চিত্র শিল্পী অঙ্কিত স্পেনীয় চকোলেট শ্রমিক । অঙ্কনকাল ১৬৮০ থেকে ১৭৮০-র মধ্যে
ঘটনা যাই ঘটুক, আমরা দেখতে পারছি এই সময়তে স্পেনের অভিজাতদের মধ্যে ক্রমে সমাদৃত হচ্ছে আদরের চকোলেট, ফলে বাড়ছে তার চাহিদা। আর চাহিদা বাড়লেই তৈরি হয় জোগানের নব-নব রাস্তা।জোগানের এই নব-রাস্তার বিস্তার করতেই ব্যবসাইয়িকভাবে শুরু হয় কোকো বিনসের চাষ।
ইতিমধ্যে
ইতালি-ফ্রান্স-সহ ইউরোপীয় অন্যান্য দেশের অভিযাত্রী, যারাই মধ্য আমেরিকা অভিযানে গিয়েছেন,
ফেরার সময় নিয়ে ফিরেছেন কোকো বিনস, নিজ নিজ দেশে শুরু করেছে কোকো বিনসের চাষাবাদ।
কোকো চাষ ছড়িয়ে পরে সমগ্র ইউরোপজুড়ে। শুরু হয় চকোলেটের ইউরোপ বিজয়।
কিন্তু অ্যাজটেকদের চকোলেটের স্বাদ ইউরোপীয়দের মন জয় করতে পারেনি। তাই ইউরোপীয়রা তেতো স্বাদ কমাতে চকোলেটে মেশাতে থাকে দারুচিনি, আখের রস, জল-সহ বিভিন্ন উপাদান। ফলে অ্যাজটেকদের চকোলেট হয়ে ওঠে আরও জিভ আহ্লাদী, আকর্ষণীয়। মানুষের মধ্যে এতটাই চাহিদা তৈরি হয় যে লন্ডন, আমস্টারডম, প্যারিস-সহ ইউরোপের বিভিন্ন জনপ্রিয় শহরে তৈরি হতে থাকে চকোলেটের দোকান।
ইতিমধ্যে শুরু হয় শিল্প বিপ্লব। ১৭৬০ থেকে ১৮৪০-এর মধ্যে ইউরোপ ও আমেরিকায় শিল্প ক্ষেত্রে বহুল পরিবর্তন ও বিবর্তন ঘটে। বেড়ে যায় দ্রব্যের চাহিদা ও উৎপাদন। স্বাভাবিকভাবে চকোলেট উৎপাদনেও তার প্রভাব পড়ে। এই সময়কালের মধ্যে চকোলেটের উৎপাদন বেড়ে যায় দ্বিগুণ। বৃদ্ধি পায় কোকো চাষ। শুধু ইউরোপ নয়, সুলভ শ্রমিক বা ক্রীতদাস সহজেই পাওয়ায় আফ্রিকা মহাদেশেও শুরু হয় কোকো চাষ এবং চকোলেটের উৎপাদন। অবশ্য শুধু আফ্রিকা নয়, ইউরোপের উপনিবেশকারীরা যেখানে যেখানে উপনিবেশ তৈরি করেছে সেখানেই আবহাওয়া কোকো চাষের উপযুক্ত হলে আদিবাসীদের কোকো চাষে বাধ্য করেছে। অ্যাডিয়েনা অরগামেলি 'দ্য বায়োগ্রাফি অব চকোলেট'-এ জানাচ্ছে, স্পেনীয় উপনিবেশকারীরা মেসো আমরিকানদের কোকো চাষ করতে বাধ্য করেছিল, কিন্তু একসময় আদিবাসীরা বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হলে শ্রমিক সংকট মেটাতে আফ্রিকান দাসদের নিয়ে আসা হয়। আফ্রিকান যোগ শুরু হয় ক্যারিবীয় মধ্য ও দক্ষিণ আমারিকাজুড়ে ছড়িয়ে থাকা চকোলেট শিল্পে। আরও বৃদ্ধি পেতে থাকে ইউরোপীয় স্বাদযুক্ত চকোলেটের।
এ
তো গেল আদি থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগ পর্যন্ত একটা ছোট্ট চকোলেট পরিক্রমা। তখনও
কিন্তু চকোলেট বর্তমান স্বাদ ও আকার কোনোটাই পায়নি, তখনও ইউরোপ ও আমেরিকা চকোলেট খাচ্ছে
পানীয় হিসেবেই,। ঊনবিংশ শতকের মধ্যভাগে এসে বিবর্তন এল চকোলেটের স্বাদ ও আকারে। ১৮৪৭-এ
ব্রিটিশ চকোলেট কোম্পনি জে. এম. ফ্রাই অ্যান্ড সন্স চিনি, তরল চকোলেট আর কোকো বাটার
মিশিয়ে তৈরি করে চকোলেট বার। খুব দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে জে. এম. ফ্রাই অ্যান্ড সন্স-এর
চকোলেট বার।
এর
কয়েক বছরের মধ্যেই আবার বিবর্তন। ১৮৭৬, চকোলেটের সঙ্গে গুড়ো দুধ মিশিয়ে মিল্ক চকোলেট
তৈরি করে ফেলেন সুইস চকোলেট ব্যবসায়ী ড্যানিয়েল পিটার। এর কয়েক বছরের মধ্যেই মিস্টার
পিটার অভিন্ন হৃদয় বন্ধু হেনরি নেসলের সঙ্গে গড়ে তোলেন নেসলে কোম্পানি। মিল্ক চকোলেট
ছড়িয়ে পড়ে মানুষের হাতে হাতে।
১৮৭৯, আরও এক সুইস চকোলেট ব্যবসায়ী রুডলফ লিন্ড এক মেশিন আবিষ্কার করেন, যা চকোলেট মিশ্রণকে আরও মসৃণ ও নরম করে তোলে। সবার কাছে চকোলেট হয়ে ওঠে আরও লোভনীয়। আরও বেড়ে যায় চকোলেট-চাহিদা।
চাহিদার কথা মাথায় রেখে এই সময় থেকেই ক্যাডবেরি, হার্সলে, মার্সের মতো চকোলেট কোম্পানি তৈরি হতে থাকে। যারা প্রতিনিয়ত গবেষণার মধ্যে দিয়ে বিবর্তন ঘটিয়ে চলেছে চকোলেটের।
খুব
ছোটো পরিসরে হলেও এই বিবর্তনের সঙ্গী হয়েছে হোম মেড। হোম মেড ইতিমধ্যেই তৈরি করেছে
বিভিন্ন আকার ও স্বাদের চকোলেট। মিল্ক চকোলেট, হোয়াইট চকোলেট, ব্ল্যাক চকোলেট, ডার্ক চকোলেট ছাড়াও হোম মেড তৈরি করেছে চার ধরনের
লিকার চকোলেট। রাম অ্যান্ড রেইজিন, রেড ওয়াই অ্যান্ড রেইজিন, ভদকা অ্যান্ড ব্ল্যাক
কারেন্ট এবং হুইস্কি অ্যান্ড ব্লুবেরি চকোলেট, যা ইতিমধ্যে চকোলেট রসিকদের কাছে হয়েছে
সমাদৃত। পেয়েছে আদর।
খুব ভালো লাগলো। অনেক কিছু জানতে পারলাম। ধন্যবাদ।
উত্তরমুছুন