কেকের জন্মবৃত্তান্ত History Of Cake
কেক কথা
কেকের জন্মবৃত্তান্ত
History Of Cake
অবশ্য
এই হাতছানি-মাদকতায় মিশে আছে আধুনিকতার ছোঁয়া। কেক আবিষ্কারের শুরুর শুরু কিন্তু এমনটা
ছিল না। ইউরোপ-আমেরিকা নয়, আফ্রিকার মিশরেই কেক আবিষ্কারের শুরুর শুরু। পরে গ্রিকরা
হাইজ্যাক করে এই সুস্বাদু আহার্য।
তখন
কেক তৈরি হত গরম পাথরে যব, মশলা, মধু, ফল, সুরার মিশ্রণ-মণ্ড সেঁকে-সেঁকে। তৎকালীন
রাজাদের রাজা-খাবার ছিল এই কেক। মিশরের তৃতীয় ফারাও র্যামসেসের কবরে পাথরে খোদাই করা
আছে যব, মধু, ফল, সুরা দিয়ে তৈরি কেকের ছবি। নিশ্চিত ফারাও-এর পছন্দের খাবার ছিল কেক,
তাই তো তাঁর সঙ্গে এখনও একই কবর-গহ্বরে যাপন করছে এই কেক-চিত্র।
কিন্তু
যা সুস্বাদু, যে অনন্য তাকে তো কোটরে আড়াল করা যায় না। টানা যায় না কোনো সীমারেখায়।
সীমান্তে। তাই মিশর টপকে কেক-রেসিপি পৌঁছে গেল সমৃদ্ধ গ্রিসে। এক দেশ থেকে আরেক দেশে।
মহাদেশ থেকে মহাদেশে। গ্রিকদের হাতের ছোঁয়ায় কেক হল আরও সুস্বাদু। আরও একটু আধুনিক।
যব, মশলা, মধু, ফল, সুরার সঙ্গে গ্রিকরা মিশিয়ে
দিলেন বাদাম, পপির বীজ। খ্রিস্টপূর্ব পাঁচ শতকে অ্যারিস্টোফেনের “দ্য লাইটস” নাটকে
এমন কেকেরই উল্লেখ পাওয়া যায়।
গ্রিকদের
হাতের ছোঁয়ায় কেকের আকৃতি হয়ে গেল গোল। অবশ্য মিশরীয়দের তৈরি কেকও গোল ছিল। আসলে তখন
তো আর ঘন-থকথকে কেক ব্যাটার তৈরি হত না। কেকের উপাদানগুলো মিশিয়ে বলের মতো নরম-মণ্ড
তৈরি করা হত, তারপর দুই করতলের চাপে বলাকার মণ্ডটি হয়ে যেত চ্যাপটা গোলাকার। এবার গরম
পাথরে সেঁকে নিয়ে তৈরি হত ফারাওদের পছন্দের কেক। অনন্যোপায়তার কারণে মিশরীয় কেক গোল
হলে গ্রিকদের অনন্যোপায়তার সঙ্গে মিশেছিল ধর্ম বিশ্বাস।
গ্রিকরা চন্দ্রদেবী আর্টেমিসের প্রতি সম্মান জানাতে,
তাঁকে সন্তুষ্ট করতে প্রতি চান্দ্রমাসের ষষ্ঠদিনে তৈরি করত চন্দ্রাকৃতি গোলাকার কেক।
আর কেককে উজ্জ্বল করতে কেকের উপর বসিয়ে দিত জ্বলন্ত মোমবাতি। তাঁদের বিশ্বাস ছিল জ্বলন্ত
মোমবাতির আলোয় তাঁদেরকে দেখতে পাচ্ছেন চন্দ্রদেবী
আর্টেমিস। আশীর্বাদ করছেন শত শত যোজন দূর থেকে।
গ্রিস সাম্রাজ্য যা পারে রোমান সাম্রাজ্যও তাই করে।
এবার গ্রিস পার করে কেক চলে গেল রোমে। আর রোম মানেই সিজার। সিজারের জন্মদিনে সিজারকে
সন্তুষ্ট করতে বিশেষ কোনো খাদ্য চাই। বিশেষ খাদ্যতালিকায় চলে এল কেক। যব,
মশলা, মধু, জলপাই, আমন্ড, সুরা দিয়ে বানানো হত বিশেষ কেক।
সিজার
মানে রাজা। আর রাজা মানেই সম-দেবতা। সম-দেবতা তো সন্তুষ্ট হল, আসল দেবতাদেরও তো সন্তুষ্ট করতে হয়। তাই দেব-দেবীর
বিশেষ আরাধনার দিনটি কেক নিবেদন হয়ে উঠল অনিবার্য।
অর্থাৎ প্রথম থেকেই কেকের যেন মাটিতে শরীর নামে না।
দেব ভোগ আর রাজ ভোগ হয়েই কাটছে বছরের পর বছর।
এবার আসা যাক ইংল্যান্ডে। ইতিমধ্যে ৩৩৬ খ্রিস্টাব্দে
রোমান সম্রাট কনস্টান্টাইনের আমলে শুরু হয়েছে বড়দিন। ক্রমশ তার ছোঁয়া পেল সমগ্র ইউরোপ।
যিশু খ্রিস্টের জন্মদিনে গোটা ইউরোপজুড়ে এখনকার মতো তখনও উৎসব-মেজাজ। তার আবার কত আচার।
বড়দিনের আগের দিন চলত উপবাস। দিন শেষে রাতে গির্জায় গির্জায় প্রার্থনা। বড়দিনের দিন
উপবাস ভাঙা হত প্লাম পারিজ খেয়ে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে খাদ্য তৈরির পদ্ধতি বদলায়। যোগ
হয় নতুন নতুন উপাদান, বাদও যায়। স্বাভাবিকভাবেই প্লাম পারিজের ক্ষেত্রেও এল পরিবর্তন।
বিভিন্ন শুকনো ফল, মশলা, মধু, ওটস মিলে প্লাম পারিজ বিবর্তিত হল পুডিং-এ। খ্রিস্টমাস
পুডিং।
কালের বিবর্তনে কেক তৈরির পদ্ধতিতে আবারও এল পরিবর্তন।
ষোড়শ শতকে খ্রিস্টমাস পুডিং থেকে বাদ গেল ওটস। ময়দা, মাখন, ডিম, শুকনো ফল মিশিয়ে তৈরি
হল মণ্ড। অনেকটা বাঙালি ঘরের পিঠের মতো। সেই
পিঠের মতো মণ্ডটি ফুটন্ত জলের পাত্রে একটি মসলিন কাপড় রেখে সেঁকে নেওয়া হত।
আর যারা বড়লোক তারা প্যানের উপর সেঁকে নিত। খ্রিস্টমাস উৎসবের বারোদিন ধরে চলত এই কেক
খাওয়া।
আরও প্রায় একশো বছর। সপ্তদশ শতক ইংল্যান্ডের বিজ্ঞান
প্রযুক্তির উন্নতির কাল। সেই উন্নতির ছোঁয়া লাগল কেকের নির্মাণে। সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি
বিভিন্ন আকৃতির কাঠ এবং ধাতুর তৈরি বেকিং-ট্রে, কেক প্যানের ব্যবহার কেক তৈরির পদ্ধতিকে
সহজ থেকে সহজতর করে তুলল। তারও প্রায় একশো বছর পর ১৮৪০-এ বেকিং পাউডারের আবিষ্কার কেককে
করে তুলল আরও আধুনিক-নমনীয়-লোভনীয়। ইউরোপের বেকারিগুলো চলে এল বাজার ধরতে। বিত্তবান
থেকে নিম্নবিত্তর কাছে, কেবল খ্রিস্টমাস নয়, প্রাত্যহিক সকালের জলখাবার থেকে নৈশাহারের
শেষে একটুকরো কেক হয়ে উঠল পরম আহার। এক সময়ের দেবতা এবং রাজাদের নৈবেদ্য হয়ে উঠল আমজনতার।
কোন মন্তব্য নেই