add

জনৈক গৃহবধূর ব্যাবসা A Random Housewife’s Business

 

জনৈক গৃহবধূর ব্যাবসা

A Random Housewife’s Business



 

 সময় বদলেছে । বদলেছে আমাদের যাপন-চর্চা । গত শতকের চায়ের ঠেক এখন হয়েছে ক্যাফে-সংস্কৃতি। প্রতি একশো মিটারে এখন একটা করে ইংরেজিমাধ্যম ইস্কুল, আন্তর্জাতিক অফিস, বেসরকারি হাসপাতাল, শপিং মল, আরও কত কী !

বদল এসেছে আমাদের কর্ম-সংস্কৃতিতে। আট ঘন্টার কর্ম-দিবস এখন উধাও । চব্বিশ ঘণ্টাই ব্যস্ততার আবরণে ঢাকা বর্তমান কর্ম-সংস্কৃতি । যেটুকু সময় পাওয়া যাচ্ছে  মানসিক-শারীরিক উৎফুল্লতার জন্য বেছে নিয়েছি হুল্লোড়। অফিসে পার্টি , বাড়িতে পাটি, জন্মদিনের হুল্লোড়-উদযাপন , বিয়ের বার্ষিকীর সবান্ধব নাচা-গানা , অফিস-প্রমোশনের সেলিব্রেশন , ছেলে-মেয়ের কৃতি রেজাল্ট , ভিন রাজ্য অথবা বিদেশযাত্রা উপলক্ষে ঘনিষ্ঠজনদের নিয়ে সান্ধ্যকালীন উল্লাস---আসলে চাই যে-কোনো একটা উপলক্ষ্য। এ যেন একেবারে  “পশ্চিমি সংস্কৃতি”।

আসলে এই বিশ্বায়নের বিশ্বে সংস্কৃতি মানে না কোনো সীমান্ত । মানে না কোনো সীমারেখা। এই নগর কলকাতায় বসেও তাল মেলাই কোনো আমেরিকান অখ্যাত গ্রামের অখ্যাত তরুণীর বাজানো গিটারে অথবা বেকার স্ট্রিটে হাঁটতে-হাঁটতে হোমস নয়, মনে পড়ে মিত্তির মশাইয়ের জাদুকরী বিশ্লেষণ।

এখন গঙ্গার ধারে বসে টেমসের কিনারে বসা কিশোরের সঙ্গে  কামড় বসাই চকোলেট ব্রাউনিতে অথবা কলকাতার ঢিমে আলোর অখ্যাত ক্যাফেতে বসে রেড ওয়াইন কেকের আস্বাদন নিই প্যারিসের পাবে বসা সদ্য যুবতীর সঙ্গে ।

বিশ্বের দুই প্রান্তে দুইজন একই সময় , একইসঙ্গে , একই খাবারের স্বাদ আস্বাদন করছে , একই ঘরানার পোশাক পরছে , একই সুরে গেয়ে উঠছে---এটাই বিশ্বায়নের মহিমা । অন্তত আমার তাই মনে হয়। আর তাই যারা নিজে কিছু করতে চায় , করতে চায় সম্মানজনক উপার্জন , পরিচিতদের মাঝে  মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকা , তারা আজই শুরু করে দিতে পারে “হোমমেড বেকা্রি”---যৎসামান্য আয়োজনে  অসামান্য ব্যাবসা।

কিন্তু কীভাবে শুরু করা যাবে এই ব্যাবসা ? কীভাবে শেখা যাবে কেক-কুকি-প্যাটি তৈরি? বিনিয়োগ কত? উপার্জনই বা কত? জানাব । সবটাই জানাব। জানাব আমার নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে । আর সেই জন্য ফিরে যাব সাম্প্রতিক অতীতে । একটু স্মৃতিচারণ।

 

জনৈক গৃহবধূর স্মৃতিচারণ

Autobiography of a Random Housewife

তখন ২০১৭ (2017) । আমার স্বামী কলেজ স্ট্রিটের “চারুপাঠ” প্রকাশনীর প্রকাশক। প্রতিষ্ঠিত প্রকাশনী। আর আমি কলকাতার একটি দৈনিক সংবাদ পত্রের প্রুফ রিডার । একমাত্র মেধাবী মেয়ে রূপকথা দাবা (Chess) খেলোয়াড়। বাড়িতে গ্লুকোমা রোগে দৃষ্টিহীন শাশুড়ি মা। এই নিয়ে মোট চার জনের সুখের সংসার। যেহেতু আমাদের----আমার, আমার স্বামীর, আমার মেয়ের এবং আমার দৃষ্টিহীন শাশুড়ি মায়ের বিশেষ কোনো চাহিদা ছিল না, একেবারে সাধারণ জীবনে অভ্যস্ত ছিলাম, নুন হলে নুন, মাংস হলে মাংস, তাই কোনো অশান্তিও ছিল না আমার সংসারে। হাসি-হাসি সংসার আরও আনন্দময় হয়ে উঠল যখন জানলাম চল্লিশের আমি সন্তানসম্ভবা। প্রথমে একটু দুঃশ্চিন্তা,একটু ভয়---চল্লিশের শরীর কি পারবে সন্তান ধারণের ধকল নিতে ! বাপেরবাড়ি বলতে বাবা, ভাই আর ভাই বউ। আমার জন্মদাত্রী মা গত হয়েছেন আগেই। তাঁর  কথা খুব মনে পড়ছিল সেই সময়। আর শ্বশুরবাড়িতে আমার শাশুড়ি মা ছাড়াও দুই ননদ ও নন্দাই , এবং তাদের কন্যাসন্তানেরা---আম্রপালি ও কহনা। তাঁরা সবাই অভয় দিলেন। মানসিকভাবে পাশে এসে দাঁড়ালেন। যথা সময়ে, ১৭ অক্টোবর ২০১৭ (17 October 2017) আমার দ্বিতীয় কন্যা রূপশ্রুতি আমার ঘর আলো করে চলে এল।

কিন্তু কথায় বলে হাসির সঙ্গে কান্না, সুখের সঙ্গে অসুখ , আলোর সঙ্গে অন্ধকার হাত ধরাধরি করে চলে। তাই এই হাত ধরাধরির নিয়ম মেনেই আমার সংসারেও অন্ধকার এল। ঘন অন্ধকার---অপমানের, অবহেলার, দুঃশ্চিন্তার অন্ধকার । আগেই বলেছি আমার জন্মদাত্রী মা গত হয়েছেন । শাশুড়ি মা দৃষ্টিহীন। ফলে সদ্যজাত দুধের মেয়ে রূপশ্রুতিকে কে দেখবে ? কে নেবে তার যত্ন ? অগত্যা যা হয় তাই হল---চাকরিটি ছাড়তে হল।

এদিকে “চারুপাঠ” প্রকাশনীর প্রকাশক স্বামীর নেশা ছিল ভালোভাবে ভালো বই ছাপা । কাজী নজরুল ইসলামের “ম্রুভাস্কর” , “কাব্য আমপারা” দেবদাস আচার্য, ব্রত চক্রবর্তী প্রমুখদের কবিতার বই , কৃষ্ণনগরের ইতিহাস । ওই সম্ভবত প্রথম মানস ভাণ্ডারীকে দিয়ে কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসের ইতিহাস মলাটবন্দি করায়। কত যে  ভালো ভালো বই , কত যে বিষয় বৈচিত্র্য---তা লিখতে গেলে অন্য প্রসঙ্গ চলে আসবে।

কিন্তু এই “ভালোভাবে ভালো বই ছাপাব” নেশাই কাল হল। আসলে নেশাই তো ধ্বংস করে। আমার স্বামী ভালোভাবে ভালো বই ছাপতে জানত , কিন্তু কীভাবে বিকোবে জানত না। লেখার জাত বুঝত, কিন্তু বাজার বুঝত না। উজান ঠেলে কৃষ্ণনগর, বহরমপুর দিনের পর দিন চলে যেত ভালো লেখার খোঁজে , কিন্তু দু-কদম দূরে দেশ পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে যেতে যত অলসতা। ফলে ভালোভাবে ভালো বই ছাপা হত, আর তা প্রকাশনীর দফতরেই জমতে লাগল। এদিকে পুঁজি শেষ, ওদিকে দেনা শুরু। বন্ধু-বান্ধবদের থেকে যখন আর দেনা পাওয়া যায় না, তখন শুরু হল চড়া সুদে বাজার থেকে দেনা নেওয়া এবং স্বপ্ন দেখা---একদিন বই বিক্রি হবে এবং সব দেনা শোধ হবে।

কিন্তু তার অন্যান্য স্বপ্নের মতো এই স্বপ্নও সফল হল না। প্রকাশনী দফতর ছাড়তে হল, আড্ডাস্থল ছাড়তে হল---যারা একসময়  পিঠ চাপড়াত তারাও ঘরে ফিরে গেল, প্রতারক তকমা নিয়ে ঘরে ফিরে এল আমার স্বামীও। আমার ছোটো কন্যাটির বয়স তখন তিন-চার মাস। বড়োটি বছর দশ। বাড়িতে গ্লুকোমা এবং শর্করা  রোগে আক্রান্ত শাশুড়ি। আমার সংসারের ভবিষ্যৎ তখন অনিশ্চিত। মাঝে মাঝে সহায় আসত আমার ভাইয়ের থেকে, ননদদের থেকে। কিন্তু এভাবে তো সংসার চলে না। আমরা তখন দিশেহারা, অসহায়, অবহেলিত।

এই  দুঃসময়ে আমার বড়ো মেয়ের বান্ধবী জাগৃতির মা নভিতা আগরওয়াল আমাকে পরামর্শ দিলেন , “তুমি কি কেক-চকোলেট তৈরি করতে পার ? তাহলে এই দাবা টুর্নামেন্টে তো নিয়ে আসতে পার। বিক্রি হবে। দুটো পয়সা আসবে হাতে।“ ( প্রসঙ্গত উল্লেখ করি, আমার বড়ো মেয়ে দাবা প্রতিযোগিতায় নিয়মিত অংশ নিত। )   

আমি কেক বানাতে পারতাম। সবাই যেমন পারে , বাড়িতে প্রেসার কুকারে বা মাইক্রো ওভেনে। আর চকোলেট বানাইনি কখনও। জানতামই না। কিন্তু তখন আমাদের দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া অবস্থা। জানি না বলে কিছু হয় না। বাড়ি ফিরে ইন্টারনেট সার্চ করলাম। পড়লাম-দেখলাম-জানলাম---কেক-চকোলেট তৈরি করার পদ্ধতি।

মনে আছে  ৮ জুন ২০১৮ ( 8 June 2018)-তে আমি আনকোরা হাতে তৈরি আধ পাউন্ড করে তিনটি, মোট দেড় পাউন্ড চকোলেট ফ্রুটস কেক , নয় পিস চকোলেট , পাঁচটা চকোলেট টার্ট নিয়ে হাজির হলাম একটা  দাবা টুর্নামেন্টে। আশা বিক্রি হবে। মনে একরাশ দ্বিধা, সংশয়, ভয়ও---এটুকু বানাতেই তো কতগুলো টাকা চলে গেল। বাচ্চারা, বাচ্চার মায়েরা কি নেবে, কিনবে এই আনকোরা হাতে তৈরি কেক-চকোলেট ? কিন্তু কী আশ্চর্য ! মাত্র কয়েক মিনিটেই সব বিক্রি হয়ে গেল। সঙ্গে পেলাম প্রশংসা। ধন্যবাদ নভিতা। ধন্যবাদ দাবা জগৎ। 

তারপর কত দাবা প্রতিযোগিতা , কত মেলা , কত ইস্কুল ক্যান্টিন---আমি আর আমার স্বামী কত রাত জেগে, দিন জেগে কেক-চকোলেট তৈরি করেছি। বিক্রি করেছি। রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে কেক ডেলিভারি করেছি। আজ আমার স্বামী একটি ক্যাফের অংশীদার। আমার তৈরি কেক-চকোলেট কয়েকটি দোকানে বিক্রি হয় , ক্যাফেতে পাওয়া যায় , অনুষ্ঠানে কেকের বরাত আসে । আজ আমাদের প্রতিষ্ঠিত “হোম মেড” ( Home Made ) কেক-চকোলেট-প্যাটি মিলিয়ে একশো রকম জিনিস তৈরি করে এবং প্রশংসিতও হয় ।

সুতরাং আমার মনে হয় একজন  যৎসামান্য গৃহবধূ , একজন দুই সন্তানের মা---এই আমি যদি পারি তবে তুমি-তুমি-তোমরাও পারবে । নিশ্চই পারবে ।

এরপর আমি বলব কী কী তৈরি করা যেতে পারে এবং জানাব বা শেখাব কীভাবে তৈরি করতে হয় । তারও আগে জানাব বা বলব কোথায় কীভাবে তোমার তৈরি জিনিস বিক্রি করা যাবে । অর্থাৎ বাজার খুঁজে বার করা বা তৈরি করা।   

1 টি মন্তব্য:

চকোলেটের ইতিকথা History of Chocolate

    চকোলেটের ইতিকথা History of Chocolate   দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এক বিষণ্ণ সকাল। হিটলার তখন ধ্বংসের নেশায় মগ্ন। ইহুদিদের রক্তে ভিজছে...

linearcurves থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.